সাগরের আর্তনাদ

সন্ধে বেলায় প্যারেড শেষে এক সহকর্মির ডাক..
— "সাগর, তুমকো মেজর সাব বুলায়া হ্যায়৷ তুমহারা ছুট্টি মন্জুর হো গয়া৷"
ছুট্টে যায় সাগর মেজরের অফিসের দিকে৷ দুদিন আগেই দরখাস্ত দিয়েছিল, এত জলদি মন্জুর হবে ভাবেনি৷ তবু আশা ছিল৷ যেতে তো তাকে হবেই, বাবার শরীর খুব খারাপ যে৷
  দক্ষিন চব্বিশ পরগণার সুদূর সাগরদ্বীপে বাড়ি৷ সেই ছাব্বিশ বছর আগে এক সন্তানহীন ধীবর তাকে কুড়িয়ে পায় সাগর পাড়ে৷ তাই নাম দেয় সাগর৷
অনেক কষ্টে তার বাবা মানুষ করেছে তাকে৷ রোদ, ঝড় জল উপেক্ষা করে নৌকোয় করে মাছ এনে বিক্রি করে ছেলের পড়ার খরচের যোগান দিয়েছে সে পিতা৷ তাইত সাগর সংসারের দুর্দশা ঘোঁচাতে কলেজ শেষ করেই যোগ দেয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে৷
সেই পিতা আজ অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী৷ সে কিছুতেই পারবেনা সেই দেবতা সম পিতাকে এ হেন অবস্থায় ফেলে সুদূর অসমে ডিউটি করতে৷
ছোটবেলা থেকেই জলের প্রতি অগাধ মোহ৷ সাঁতারে তো খুব পটু ছিল প্রথম থেকেই৷ গাঁয়ের অনেকে বলত এ যেন সমুদ্রেরই সন্তান৷ সাঁতারের কত যে কায়দা তার জানা, আর সেজন্যই তো স্পোর্টস কোটায় পেয়ে গেল চাকরিটা৷
যাই হোক পনের দিনের ছুটি নিয়ে পরদিন ভোরের ট্রেন ধরল৷ দেড়দিন পর ট্রেনে ট্রেনে পৌছোল নামখানা স্টেশনে৷ তখন প্রায় দুপুর দুটো৷ স্টেশনে নেমেই গোপালদার দোকানে এক কাপ চা খেয়েই আবার রওনা৷ টোটো ধরতে হবে লঞ্চঘাটে যাবার জন্য৷ মিনিট পনেরোর মধ্যেই ঘাটে এসে লঞ্চে চেপে ব্যাগ দুটো রেখে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ গঙ্গার এই স্নিগ্ধ বাতাস কতদিন তার গায়ে লাগেনি৷ চল্লিশ মিনিটের লঞ্চ যাত্রায় কৈশোরের স্মৃতি একবার ফের ঝালিয়ে নিল৷ নেমেই আবার ম্যাজিক ভ্যান ধরে সোজা সাগরদ্বীপ৷
গ্রামে প্রায় ন-মাস পরে এল সাগর৷ কত কী পাল্টে গেছে, ঢালাই রাস্তা, রাস্তার ধারে ধারে ত্রিফলা ল্যাম্পপোষ্ট, মন্দিরের সামনে টাইলস বসানো, হাওয়া কল বসেছে৷ বাহঃ, বেশ উন্নতি হয়েছে গ্রামের৷
বাড়িতে ঢুকেই মায়ের সে কত আদর, বাপটা যেন প্রাণ ফিরে পেল সাগরকে দেখে৷ মায়ের কথা যেন আর শেষই হয়না...
— "জানিস তোর বাবা তোর পাঠান টাকা জমিয়ে একটা বড় জেটি কিনেছে৷ ওই ছোট্ট ডিঙিটা নিয়ে মাছ ধরতে বেশি দূর তো আর যেতে পারত না৷"
— "আচ্ছা মা ওই ডিঙিটা কোথায় আছে? বিক্রি করে দেয়নি তো?"
— "তোর সাধের ডিঙি কি আর বিক্রি করতে পারে তোর বাবা? ওটা মেরামত করে পাড়েই রাখা আছে৷"
কিছু খাবার খেয়ে ভাবল একবার সমুদ্রের পাড় থেকে ঘুরে আসা যাক৷ মেঘটাও বেশ কালো হয়ে আছে, বৃষ্টি নামতে পারে৷ তা নামুকগে, গাঁয়ের রাস্তায় কতদিন হল বৃষ্টিতে ভেজেনি৷ আজ নাহয় ভিজলামই একটু৷ এই ভেবে বেরিয়ে পড়ল সাগর সাগর পাড়ের দিকে হাঁটতে হাঁটতে৷ হাওয়া বেশ ভালই চলছে বাইরে, আস্তে আস্তে আরও বাড়তে লাগল৷ পাড়ের কাছাকাছি চলে এসেছে সেই সময় স্বপনদার সাথে দেখা৷
— "আরে, সাগর লয় ? হঅঅ, ঠিক চিনেছি৷ কবে আসলি? তুই ত মস্ত অফিসার হইয়ে গেছিস৷ চেহারাটাও ভালই হইয়েছে৷"
—"এই তো একটু আগেই গাঁয়ে ঢুকলাম৷ ভাবলাম একবার পাড়ের দিকে ঘুরে আসি৷ তুমি কেমন আছ?"
— "আমাদের আর কেমন চইলবে, ওই চইলে যাচ্ছে মাছ বিক্রি করেই৷ দেখনা একটু আগেই খবরে বলল কদিন খুব ঝড় জল হবেক৷ মাছ ধরতে যাওয়াও বন্ধ কদিন কে জানে৷"
কথায় কথায় বেশ জোরে ঝড় শুরু হল৷ দুজনে দৌড়ে গিয়ে দাঁড়াল একটা চা দোকানে৷

দুদিন ধরে খুব বৃষ্টি, ধীবর প্রজাতির সমুদ্রে মাছের সন্ধান বন্ধ৷ কাহাতক আর ঘরে সারাদিন বসে থাকা যায়, তাই সাগর আবার সেই সমুদ্রের পাড়ের দিকে ছাতা নিয়ে বেরোল৷ পাড়ে এক দোকানে চা খেতে খেতে রেডিওতে খবর...

" বঙ্গোপসাগরে মোহনার নিকট একটি যাত্রি বোঝাই ছোট জাহাজ বিপদগ্রস্থ অবস্থায় আছে৷ সন্দেহ করা হচ্ছে কোন কারনে জাহাজে ফাটল ধরার কারনে জল ঢুকতে শুরু করেছে৷
উদ্ধার কার্যের জন্য একটি বিশেষ দল গঠন করা হয়েছে৷ দলটি কিছুক্ষণ আগেই সাগরদ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে৷ মৎস্যজীবিদের অনুরোধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সমুদ্রে যাবেন না৷"

খবর শুনেই সাগরের মনে উঠল ঝড়৷ এ ঝড় সামুদ্রিক নয়, মানসিক৷ এত কাছে থাকা সত্ত্বেও সে কি কিছুই করতে পারবেনা ওই গভীর সমুদ্রের নিষ্পাপ যাত্রিদের জন্য ? তার এত ট্রেনিং, সাঁতার প্রতিযাগীতার চ্যাম্পিয়ন হওয়া, দেশের মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করার শপথ, সবই কি ব্যার্থ হয়ে যাবে? না, উদ্ধার কার্যে যেতেই হবে৷ মানসিক ভাবে সম্পূর্ন প্রস্তুত সাগর৷ মুখের সিগারেটটা শেষ করেই পাশে বসে থাকা বিকাশ দা কে বলল...
—"বিকাশ দা আমাদের ছোট জেটিটা কোথায় রাখা আছে জানো?"
—"হ্যা, ওই তো একটু এগিয়ে গিয়েই একটা গাছে বাঁধা আছে৷ কিন্তু এই ঝড় জলে জেটি নিয়ে কি করবি?"
—"শুনলে না, কাছাকাছি কোথাও একটা জাহাজ খুব বিপদে পড়েছে, কত লোক আছে৷ জাহাজে নাকি জল ঢুকেছে৷ একজন সৈনিক হয়ে এতগুলো লোকের বিপদ শুনেও চুপ করে বসে থাকব? না, তা হয়না বিকাশ দা৷ আমাকে যেতেই হবে৷"
—"বোকামি করিসনা সাগর, সমুদ্র ফুঁসছে এখন৷ তুই ছোট জেটি নিয়ে একা কিভাবে এত মানুষকে বাঁচাবি?"
—"একজনকে হলেও তো পারব৷ সেখানেই আমার এত বছরের ট্রেনিং, সাঁতারে মেডেল, এগুলো সার্থকতা পাবে৷ তোমার মনে আছে, তুমি সেবার আমার সাথে জেলার সাঁতার প্রতিযোগীতায় তৃতীয় হয়েছিলে, আর আমি চ্যাম্পিয়ন৷ তারপর তুমি স্কুল মাস্টারের চাকরি নিয়ে গাঁয়েই রয়ে গেলে৷"
—"হ্যা রে, খুব মনে আছে৷ আমার সেই সাঁতার আর কোন কাজেই লাগেনি৷ শুধু একটা সার্টিফিকেট কোথায় যে ফাইল বন্দী হয়ে পড়ে আছে....."
—"আজ কাজে লাগতে পারে বিকাশ দা৷ তুমি যাবে আমার সাথে জেটি নিয়ে? তুমি চালিও, আমি উদ্ধার করব৷"
—"কিন্তু....."
—"আর কোন কিন্তু নয় বিকাশ দা৷ মানুষগুলোর খুব প্রয়োজন আজ তোমাকে৷ "
—"চল্ তাহলে, দেখা যাবে যা আছে কপালে৷ বিয়ে থা ও করিনি এখনো, মরলে মরব দেশের মানুষের জন্য৷ চল্ ..... "

সামনের দোকানে রাখা দশ লিটারের পেট্রোলের জারটা উঠিয়ে দৌড় দিল জেটির দিকে৷ পেছন ফিরে একবার বলল সাগর....
—"ঘনা দা, জারটা নিয়ে গেলাম......"
শেষ শব্দগুলো আর শোনা গেল না সমুদ্রের বিশাল আর্তনাদের মাঝে৷

জেটি চলছে সমুদ্রে, ছোট বেলার আলিফ লায়লার কথা মনে পড়ে গেল সাগরের৷ সিন্ধবাদ এভাবেই তার জাহাজ নিয়ে সমুদ্রের মাঝে.....
হঠাৎ দেখে এক ক্ষীণ লাল আলো ভরা সমুদ্রে যেন বিপদের সংকেত দিচ্ছে৷
—"বিকাশ দা, ওই দেখ পশ্চিম দিকে জাহাজের লাল আলো জ্বলছে ওই দিকে চালাও জেটি৷"

জেটি তখন প্রচন্ড দুলছে৷ তবু এগিয়ে চলল বিকাশ৷ জেটি চালাতে সে ভালই জানে, বাবার সাথে আগে অনেকবার বেরিয়েছে সমুদ্রে মাছ ধরতে৷ জাহাজের সাথে আস্তে আস্তে দূরত্বটা কমছে কিন্তু কারও চিৎকার তো শোনা যাচ্ছেনা৷ জাহাজের সাইরেনও শুনতে পাচ্ছেনা৷ ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না সাগর৷ আরও একটু যেতেই বোঝা গেল বিপদের ভয়াবহতা৷ ওখানে ঘুর্ণী উঠেছে, হয়ত এ কারনেই যন্ত্র বিকল হয়ে আর এগোতে পারছে না৷
—"বিকাশ দা, আর একটু আছে, কাছে এসে গেছি প্রায়৷"
—"আর খুব বেশি সামনে যাওয়া যাবেনা মনে হচ্ছে রে৷ সামনে ঘূর্ণী দেখতে পাচ্ছি৷ থেমে গেলে কাছে যাওয়া যাবে৷"
সাগর নিরূপায় হয়ে সময় গুনতে লাগল৷ কিছুক্ষন পর মনে হচ্ছে ঘূর্ণীঝড় তার দিক পরিবর্তন করেছে৷
—"বিকাশ দা, এবার চল সামনে৷ ঘূর্ণী পূর্বদিকে যাচ্ছে৷"
জেটি এবার সবেগে চলতে লাগল, কিন্তু একি জাহাজ তো প্রায় ডুবতে বসেছে৷ কিন্তু কোন লোক নেই কেন? সন্ধে হয়ে আসছে, দশ শেলের টর্চ টা বের করল সাগর৷ সমুদ্র তখনো ফুঁসছে৷ টর্চের আলোয় কয়েটা হাত জলের মধ্যে দেখতে পেল, শুনতে পেল বাঁচাও বাঁচাও৷ জাহাজটা এবার ডুবে গেছে অনেকটাই৷ অারও কাছে আসতেই দেখল অনেকগুলো মানুষ ভয়ে আগেই ঝাঁপ দিয়েছে জলে৷ বিকাশ এবার ভেতর থেকে ডাক পাড়ল...
—"আর সামনে যাওয়া যাবেনা৷ জাহাজটা ডুবছে, আর সামনে গেলে আমরাও ডুবে যাব৷"
কথাটা শুনেই সাগর জেটিতে গুটিয়ে রাখা দড়িটা খুলল, সঙ্গে দুটো টিউব নিয়ে বলল...
—"আমি ঝাঁপ দিলাম৷ তুমি জেটিটাকে এখানেই দাঁড় করিয়ে রাখ৷ দড়িটা বাঁধা আছে৷ ভয় পেওনা....."

বলেই এক নিমেষে ঝাঁপ দিল সাগর৷ বিকাশ ভাবছে এই ভরা সাগরে ঝাঁপ দিল সাগর নিজে, আর তাকে বলে গেল ভয় না পেতে! এজন্যই হয়ত ওদের জওয়ান বলে, নিজের জীবন বাজি রাখার আগেও অন্যকে অভয় দেয়, সত্যি আজ একটা স্যালুট করতে মন যাচ্ছে এরকম লক্ষ লক্ষ জওয়ানদের৷
সাগর এগিয়ে চলেছে সাঁতরে, কোমরের বেল্টে বাঁধা দড়ি, একটা টিউব সেই দড়িতে বাঁধা আর একটা তার হাতে৷ দেখতে পাচ্ছে জাহাজের অবশেষ অংশও ডুবে গেল সশব্দে, সঙ্গে না জানি কত মানুষ তলিয়ে গেল সমুদ্রের গভীরে৷ তবুও সে হাল ছাড়বে না৷ সাঁতরাতে সাঁতরাতে সামনে দেখল একটা মানুষ কিছু একটা ধরে ভেসে থাকার চেষ্টা করছে আর হাত বাড়িয়ে চিৎকার করছে৷ আরও কিছুটা সাঁতরে যেতেই এক নারীকন্ঠ...
—"বাঁচাও.... বাঁচাও...."
ঢেউ তখনো আসছে বেশ বড়ই৷ জাহাজের পাটাতনের একটা ভাঙা অংশ নিয়ে কোনমতে ভেসে আছে, শুধু মাথাটা জলের ওপরে আর দুটো দিয়ে শক্ত করে পাটাতন ধরে প্রাণটি এখন মৃত্যুর সম্মুখে৷ ডুবে যাওয়া জাহাজের থেকে একটু দূরে থাকায় এ যাত্রায় বেঁচে গেছে৷
সাগর টিউব নিয়ে পৌছোয় মেয়েটির কাছে৷ কোমরে বাঁধা দড়ির সাথে লাগানো টিউবটা দড়ি সমেত খুলে গলিয়ে দেয় মাথার ওপর থেকে৷ যাক এবার আর ডোবার ভয়টা নেই৷ টিউব সমেত মেয়েটি জড়িয়ে ধরে সাগরকে, যেন ওপরওয়ালা এই ভয়ঙ্কর দুর্যোগের উত্তাল সমুদ্রে কোন দূত পাঠিয়েছেন তার জীবন বাঁচাতে৷ সাগর আবার সেই দৃঢ় জওয়ানের ভাষায় বলল...
—"ভয় পাবেন না, আমি আছি৷ টিউবটা শক্ত করে ধরে থাকুন৷ একটা লম্বা দড়ি বাঁধা আছে ওটার সাথে৷ আমাদের জেটি একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে৷"
মেয়েটি ভয়ে তখনো সাগরের হাত ছাড়েনি৷ সাগরের চোখ তখনো খুঁজছে যদি আরও কেউ বেঁচে আছে, যদি উদ্ধার করা যায়৷ নাঃ, আর কারও আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না৷ তবে কি শুধু এই মেয়েটিই বেঁচে আছে এত মানুষের মধ্যে? এতগুলো মানুষকে চোখের সামনে মরতে দেখেছে মেয়েটা! সেই মৃত্যুর বিভিষিকার ভয়ঙ্কর ছবি যেন ভয়ে মুষড়ে দিয়েছে৷ ছোট বড় ঢেউ আসছেই অবিরত৷ বৃষ্টি এখনো পড়ছে মুষলধারেই৷ দড়ি ধরে ধীরে ধীরে সাঁতরে এগোতে লাগল মেয়েটি জেটির দিকে৷ সাগর নিজের টিউবটা মাথা দিয়ে গলিয়ে ভেসে থাকা পাটাতনটা দু হাত দিয়ে ধরে সাঁতরে যেতে লাগল মেয়েটির পাশে পাশেই৷
হঠাৎ একটা বড় ঢেউ, মেয়েটি ভয়ে চিৎকার করে উঠল৷ সাগর সামনে গিয়ে আবার ধরল তার হাতটা৷ দড়িটা বাঁধাই আছে মেয়েটির টিউবের সাথে৷ আবার একটা বড় ঢেউ৷ দুজনেই বেশ কিছুদূর ভেসে গেল ঢেউয়ের সাথে৷ দড়িটা ধরে টানতে গিয়ে আতঙ্কিত স্বরে সাগর অস্ফুটে বলে উঠল...
—"একি! দড়িতে টান লাগছে না কেন?"
এবার আরও ভয় পেল মেয়েটি৷
—"কি!! দড়ি কি ছিঁড়ে গেছে? এবার কি হবে?"
ভয়ে সাগরকে শক্ত করে ধরে কাঁদতে লাগল৷ ঢেউ তাদের অনেক দূরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে৷ জেটি থেকে অনেক দূরে৷ সন্ধে হয়ে গেছে৷ মাঝ সমুদ্রে জেটির আলো বেশ ক্ষিন হয়ে এসেছে৷ দড়িটা প্রায় সাতশো মিটার লম্বা৷ তাই বেশ দূরেই চলে এসেছে এটা বেশ ভালই বুঝতে পারল সাগর৷ হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল৷ দড়িটা টানতে লাগল সাগর৷ এবার পাটাতন কে অনেক কষ্টে টিউব দুটোর সাথে বাঁধল৷ পাটাতনের ওপরে এবার বসলেও ডুববে না৷ দুজনের ভারও নিয়ে নেবে৷ মেয়েটিকে ওপরে বসিয়ে দিল, নিজে পাটাতন ধরে জলে ভেসে রইল৷ এবার সাঁতার কেটে পাটাতন সমেত জেটির কাছে পৌছোতে হবে৷ সময় প্রায় এক ঘন্টা অতিক্রান্ত৷ বিকাশ জেটিতে বসে কি ভাবছে কে জানে৷ এ কি!! জেটি অন্যদিকে যাচ্ছে কেন? নাকি এতক্ষন হয়ে গেছে বলে বিকাশ খোঁজার জন্য জেটি ঘোরাচ্ছে? হায়!!! আর হয়তো খুঁজে পাবেনা বিকাশ৷ সমুদ্রের মাঝে দিক নির্ণয় করাও বড় মুশকিল৷
হতাশ হয়ে পড়ে সাগর৷ এবার পাটাতনে উঠে বসে বলে...
—"এখন আর কোন উপায় নেই৷ রাতটা এভাবেই কাটাতে হবে৷ অনেকটা দূরে চলে এসেছি আমরা৷ ঢেউটা এখন কম এটাই বাঁচোয়া৷ তবে মাঝ সমুদ্রে ঢেউ খুব বেশি থাকেনা৷ আপনি ভয় পাবেন না, আমি একজন ফৌজি৷ আমি বেঁচে থাকতে আপনার কিছু হতে দেবনা৷"

মেয়েটির মুখে কোন কথা নেই৷ চোখের সামনে তলিয়ে যাওয়া জাহাজ, মানুষের মৃত্যুর পূর্বের আর্তনাদ, শেষ আশার জেটি ছেড়ে চলে যাওয়া, সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ের ভয়াবহতা বাক্ শক্তি কেড়ে নিয়েছে৷ এখনো শক্ত করে ধরে আছে সাগরের হাত৷
রাত এভাবেই কাটলো, যেন কয়েক বছরের সমান সময়৷ ভোরের আলো দেখা যাচ্ছে এবার৷ সমুদ্রের ঢেউ কতদূরে নিয়ে এসেছে কে জানে?
সাগর চারিদিকে দেখতে লাগল৷ বলে উঠল..
—"দূরে অনেকগুলো গাছ বা জঙ্গল দেখা যাচ্ছে৷ তার মানে ওখানে চড়া আছে৷ হয়তো বা কোন দ্বীপ আছে ওখানে৷"
—"চল তাহলে ওদিকেই৷"
মেয়েটির গলার স্বরে তখনো ভয়াবহতার চিহ্ন স্পষ্ট৷ সাগর বলল..
—"আপনি ওদিক থেকে জল ঠেলুন, আমি এপাশ থেকে ঠেলছি৷ ঠিক যেভাবে নৌকোর দাঁড় টানে৷"
বৃষ্টি তখনো হালকা হালকা পড়ছে৷ দুজনে সেই ভেজা অবস্থায় জল ঠেলতে লাগল৷
প্রায় দু ঘন্টার পরিশ্রমের পর দেখল অনেক কাছাকাছি এসে গেছে৷ এবার জলে নামলে পায়ে মাটি পাওয়া যাবে৷ সাগর নামল এবার পাটাতন থেকে, নেমে ঠেলতে লাগল৷ অবশেষে এক নির্জন দ্বীপে এসে পড়ল দুজনে৷ নেমেই দৌড়োতে লাগল মেয়েটি কোন বড় গাছের উদ্দেশ্যে৷ এই বৃষ্টিতে আর কিছুক্ষন ভিজলে নিউমোনিয়া অবশ্যম্ভাবী৷ সাগর পেছন পেছন টিউব সমেত পাটাতনটা পাড়ে নিয়ে এল৷
বৃষ্টি থামল কিছু পরেই, মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে রোদ৷ দুজনেরই সর্বাঙ্গ ভেজা৷ একটা আস্তানা খুঁজতেই হবে৷ সাগর বলল...
—"আপনি এখানেই দাঁড়ান, আমি চারিদিকটা একটু দেখে আসি, যদি কোথাও কোন মাথা গোঁজার ঠাই মেলে৷"
—"আমিও যাব আপনার সাথে৷ আর আমার নাম তৃষা৷ তুমি করেই বলতে পারেন৷ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এভাবে আমাকে বাঁচানোর জন্য৷"
—"এটা আমার কর্তব্য, আমি একজন জওয়ান৷ আচ্ছা চলো এবার৷ তোমার কাপড় সব ভেজা৷ এভাবে থাকলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে৷"
—"আপনারও তো সব ভেজা৷"
—"আপনি না, আমাকেও তুমি বলতে পারো৷ আমার নাম সাগর৷"

দুজনে জঙ্গলের মাঝে হাঁটতে লাগল৷ একটা নির্জন দ্বীপ, চারপাশে সমুদ্র, এখানে শুধু নানান রকম গাছ আর পাখি ছাড়া কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা৷ এক ঘন্টার বেশি ঘুরেছে তারা এখানে, কোন বাড়ি, ঘর বা নিদেন পক্ষে একটা ঝুপড়িও নেই৷ সাগর জানে এই অবস্থায় কি করা দরকার৷ ফৌজির ট্রেনিংয়ে এ সব শেখান হয়৷ কিছু ইউক্যালিপটাস, আর কিছু খেজুর গাছের ডাল ভাঙল৷ এবার সামনে একটা বড় বট গাছের ঝুরির সাথে বেঁধে দুটো আলাদা ছোট্ট ঝুপড়ি তৈরি করে তৃষাকে বলল...
—"তুমি ওই ঝুপড়িতে ঢুকে সালোয়ারটা ভালো করে নিঙড়ে ঝেড়ে তারপর পরে নাও৷ জল ঝড়ে গেলে এই সমুদ্রের হাওয়ায় দশ মিনিটেই শুকিয়ে যাবে৷ এখন আবার রোদও উঠেছে একটু৷ আমিও এই পাশের ঝুপড়িতে আমার কাপড়গুলো নিঙড়ে নিই৷"

তৃষা ইতস্ততঃ বোধ করতে লাগল৷ তবু কেমন যেন একটা বিশ্বাস জন্মেছে সাগরের প্রতি৷ যে মানুষটা নিজের জীবনের পরোয়া না করে তার জীবন বাঁচাতে পারে, সমুদ্রের মাঝে ভয়ঙ্কর দুর্যোগে একটা পাটাতনে বসে সারারাত কাটাতে পারে, নিজের ঘর ছেড়ে তার জন্য এই নির্জন দ্বীপে ঝুপড়িতে থাকতে পারে, তাকে আর যাই হোক অবিশ্বাস করা যায়না৷ এ মানুষ তো ভগবানের দূত হয়ে এসেছে৷ ভাবতে ভাবতে তৃষা একটা ঝুপড়িতে ঢুকে যায়৷ দুজনে দুটি পাশাপাশি ঝুপড়িতে কাপড় শুকানোর মাঝে কথাও বলছে একে অপরের সাথে৷ সাগর কথা বলছে এমন সময় তৃষার কোন উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না৷ বেশ কয়েকবার ডাকল৷ নাঃ, কোন সাড়া নেই৷ একবার  কি বেরিয়ে গিয়ে দেখবে? না, কি অবস্থায় আছে কে জানে৷ সন্দেহবশতঃ বেরিয়ে দেখল তৃষার ঝুপড়ির ওপরে সালোয়ারের ওপরের অংশ শুকোতে দেওয়া৷ আবার ডাকল..
—"তৃষা.... তৃষা....."
নাঃ, কোন শব্দ নেই৷ এবার ঝুপড়িতে একবার উঁকি দিতেই দেখল ঝুপড়ির মাঝ বরাবর বট গাছের শক্ত ঝুরিটায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছে তৃষা৷ অন্তর্বাস খোলা পিঠ দেখা যাচ্ছে৷ এ কি করছে সে? এভাবে কোন মেয়েকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় দেখা তার ঠিক হয়নি৷ এই সব সাতপাঁচ ভাবছে ঠিক সেই সময় তৃষার ঘুম ভেঙে যায়৷ সাগরকে দেখেই চিৎকার করে ওঠে....
—"এ কি তুমি ! আমাকে এভাবে দেখলে তুমি? এদিকে কেন এসেছ? "
পেছন ঘুরে দুহাত দিয়ে নিজের দেহ ঢাকার চেষ্টা করে৷ সাগর এবার শুকান সালোয়ারটি হাত দিয়ে বাড়িয়ে বলল...
—"সরি, সরি, আমি চাইনি তোমার এদিকে আসতে৷ কিন্তু অনেকবার ডাকলাম তোমায়, কোন সাড়া না পেয়ে... আই এম ভেরি সরি..."

পেছনে হাত বাড়িয়ে সালোয়ারটা নিয়ে তৃষা বলল ...
—"ওহ, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ ইটস ওকে, তোমার কোন দোষ নেই৷"
সাগর অপরাধবোধে দূরে গিয়ে পিছন ফিরে দাঁড়ায়৷ কিছুক্ষন পর তৃষার ডাক...
—"সাগর, আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে৷"
মৌনতা ভেঙে সাগর বলল...
—"এই জঙ্গলে কিছু খাবার পাওয়া যাবে বলে তো মনে হচ্ছে না৷ আমারও বেশ ক্ষিধে পেয়েছে৷ মনে হচ্ছে দুপুর প্রায় দুটো বাজবে৷ দেখি কোন ফল পাই কি না এই জঙ্গলে৷"
বেশ কিছুক্ষন পর সাগর ফিরে এল বেশ কিছু খেজুর, আধ পাকা আম নিজের গেঞ্জির মধ্যে বেঁধে৷ তৃষাকে সব দিয়ে বলল...
—"খাবার তো পাওয়া গেল, এখন খাবার জলেরও ব্যবস্থা করতে হবে৷"
—"এখানে কোথায় খাবার জল পাবে? সবই তো সমুদ্রের নোনা জল৷"
—"ওই যে দেখছো নারকেল গাছ, ওখান থেকে৷"
—"তুমি এত বড় গাছে উঠতে পারবে?"
কথাটা শেষ হবার আগেই সাগর হাঁটা দিল নারকেল গাছের দিকে৷ প্রায় আধঘন্টা পরিশ্রমের পর ফিরল দু হাতে চারটে ডাব নিয়ে৷ ফল খেয়ে, পাথরের ঘায়ে ডাব থেকে জল বের করে যেই জল পান করে বেশ তৃপ্তি পেল দুজনেই৷ বিকেল হয়ে গেছে৷ মেঘ এখনো বেশ আছে আকাশে৷ যেকোন সময় বৃষ্টি নামাও অস্বাভাবিক নয়৷ এই সময় এই দ্বীপে কোন জাহাজ বা ডিঙি আসার সম্ভাবনা কোনভাবেই নেই৷ আজ রাতটা এখানেই কাটাতে হবে মনে হচ্ছে৷ এখানে সাপ বা অন্য কোন জন্তুর আগমন হতেই পারে যেকোন সময়৷ তবুও আজ রাত্রে এভাবেই ঝুপড়িতে কাটানো ছাড়া উপায় নেই৷ আজ সারাদিন তৃষার সাথে গল্প করতে করতে বেশ বন্ধুর মতো হয়ে গেছে দুজনেই৷ বিকেলে সমুদ্র সৈকতে হাওয়া খেতে খেতে তৃষার কলকাতার গল্প, কলেজের গল্প সবই শুনল সাগর৷ সেও বলল তার জীবনের বিশেষ কিছু ঘটনা, অসমে একজন সীমান্তরক্ষীর জওয়ানের ডিউটির অনেক কাহিনী৷ বলতে বলতে মনের বেশ কাছাকাছি চলে এল দুজনে৷ তৃষার কথা বলতে পারবে না, কিন্তু সাগর তৃষার গভীর চাউনি, পুরু ঠোঁট, ফর্সা রঙের তন্বী নারী, ওই হলদে সালোয়ারে রঙটা যেন আরও ফুটে উঠেছে৷ মনে মনে ভাবল এক জওয়ানের পাশে তৃষাকে খুব মানাবে স্ত্রী হিসেবে৷ সমুদ্রের ধারে হাঁটতে হাঁটতে কত কী কল্পনা করে নিয়েছে সাগর৷ তৃষা এখনো বলেই চলেছে নিজের কথা৷ হঠাৎ কি মনে হল....
—"সাগর, কি ভাবছ ? "
—"নাঃ, কিছু না৷ আমি শুনছি তো৷"
—"না, শুনছিলেনা তুমি৷ বলো কি ভাবছিলে?"
—"তোমাকে বেশ সুন্দর লাগছে খোলা চুলে"
বেশ অকপটেই বলে ফেলল সাগর৷ শুনেই তৃষার সেই পাগল করা বাঁকা ঠোঁটের হাসি যেন রন্ধ্রেরন্ধ্রে বিদ্ধ করছে সাগরকে৷ আবার শুরু হল টিপটিপ বৃষ্টি এই সন্ধে বেলায়, অন্ধকার করে আসছে চারিদিক৷ দুজনে বেশ জোরেই পা চালাতে লাগল ঝুপড়ির দিকে৷ তৃষা জোরে হাঁটতে না পেরে সাগরের হাত ধরে হাটতে লাগল৷ দুজনের কারো পায়েই কিছু নেই৷ খালি পায়ে হাঁটার ওভ্যেস সাগরের থাকলেও তৃষার নেই৷ হঠাৎ পায়ে একটা ভাঙা শামুকের খোলাতে পা কেটে যায় তৃষার৷ বসে পড়ে সে৷ খুব বেশি লাগেনি যদিও, সাগর তৃষার পা থেকে ভাঙা খোলা বের করে দিল৷ হাঁটতে পারছে না তৃষা৷ অগত্যা সাগরকে কোলে উঠিয়ে চলতে হচ্ছে৷ নিজেকে এখন কোন হিন্দি সিনেমার হিরোর থেকে কম লাগছে না৷ তৃষার বুক ঠেকে আছে সাগরের বুকে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছেই৷ শেষে ঝুপড়ির কাছে পৌছাল৷ সন্ধে হয়ে গেছে, মেঘের ফাঁকে মাঝেমাঝে চাঁদের আলো দেখা যাচ্ছে৷ সাগরের বেশ রোমান্টিক লাগছে ব্যাপারটা৷
তৃষা ভয়ে আলাদা ঝুপড়িতে যায়নি, দুজনে এক জায়গায় বসে গল্প করছে৷ রাতের গল্পটা গাছের ফাঁক দিয়ে পড়া চাঁদের আলোতে বেশ জমে উঠেছে৷ হঠাৎ এক অচেনা শব্দে তৃষা ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরে সাগরকে৷ সাগরও সহসা ভেবে পায়না কিছু৷ তৃষা জড়িয়ে ধরেই বলে...
—"আমার অন্ধকারে খুব ভয় লাগে৷"
সাগরও জড়িয়েই ধরে থাকে৷ আবেগের কাছে হার মানে বিবেক, সাগরের ঠোট ছুঁয়ে যায় তৃষার গলা, পিঠের খোলা অংশ৷ বাধা দেয়না তৃষাও৷ ঠোঁট ছুয়ে যায় ঠোঁটে, সাগরের হাতের আদরে বশীভূত হয় তৃষার শরীর৷ গরম নিঃশ্বাসে গলে যায় দুটি মন৷ চাঁদের আলো, সমুদ্রের বাতাস, এই বট গাছ স্বাক্ষি থাকে দুজনার মিলনের৷ ক্লান্তির ক্লেশ ক্ষরিত হয়ে সুখশয্যায় শায়ীত হয় দুজনে৷ সকালে তৃষা আবিষ্কার করে নিজেকে সাগরের বুকে৷
আজ সকাল থেকে রোদ উঠেছে ভালই৷ সাগরকে খুজতে বেরিয়েছে বিকাশ এবং গাঁয়ের কিছু ছেলে মিলে৷ সকাল থেকে সাগর আর তৃষা সমুদ্রের ধারেই ঘুরছে, যদি কোন জেটি দেখতে পায়৷ একটা রাতেই দুজনের সম্পর্কটা বেশ বদলে গেল, অন্ততঃ সাগরের কাছে৷ সকাল থেকে তৃষার সাথে কথাগুলো যেন অনেক আপনজনের সাথে বলা কথার মতো লাগছে৷
প্রায় ঘন্টা চারেক প্রতিক্ষার পর দূরে এক জেটি দেখতে পেল তৃষা...
—"সাগর.. ওই দেখ একটা নৌকো, হেল্প, হেল্প...."
সাগর একটা ইউক্যালিপটাস গাছের ডাল ভেঙে নিজের মেরুন রঙের টি-শার্টটা বেঁধে ওপরে উঠিয়ে নাড়াতে লাগল৷ প্রায় মিনিট দশের মধ্যেই জেটিটি বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে৷ তৃষা আর সাগর সমানে চিৎকার করছে৷ কিছুক্ষন পরেই একেবারে কাছে চলে এসেছে জেটি৷ সাগর দেখে বিকাশ ওপর থেকে হাত দেখিয়ে নিচে নেমে সাগরকে জড়িয়ে ধরে...
—"তুই কেমন আছিস, দুদিন এই ভয়ানক দ্বীপে কিভাবে ছিলি? জানিস এখানে সবাইকে আসতে নিষেধ করা হয়৷ জম্বুদ্বীপ নাম এটার৷ শোনা যায় বছর খানেক আগে এখানে দুজন নেমেছিল৷ তাদের বাঘে খেয়েছে৷ ভাগ্য ভাল তোদের কিছু হয়নি৷ চল এবার, বাড়িতে কাকি কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে৷ আমি সেদিন তোকে খুজলাম অনেক জানিস, কিন্তু কোথাও পেলাম না৷"
আবেগের অশ্রু গড়িয়ে আসে বিকাশ দার চোখে৷ সাগর বলে..
—"আমরা ঠিক আছি বিকাশ দা, চল এবার যাওয়া যাক৷ মা নিশ্চই খুব চিন্তা করছে৷"
তিনজনেই উঠে বসে জেটিতে৷ সবার সাথে তৃষার পরিচয় পর্বও শেষ৷ সাগরের হাবভাব দেখে তৃষার প্রতি তার দূর্বলতা টের পেয়েছে৷ বাড়িতে পৌছে দুজনকে দেখে সাগরের মায়ের আনন্দ আর ধরেনা৷ ভাল করে স্নান করে খাবার খাবার পর তৃষা একটা আলাদা ঘরে ঘুমোতে গেল আর সাগর তার মায়ের কাছেই শুয়ে পড়ল৷ ঘুমোবার আগে মায়ের কাছে তার তৃষার প্রতি দূর্বলতা আর পছন্দের কথা বলল সাগর৷ মায়েরও বেশ পছন্দ হয়েছে তৃষাকে৷
সন্ধে বেলা ঘুম থেকে উঠে তৃষা সাগরকে বলল..
—"আমার মোবাইল তো সমুদ্রেই পড়ে গেছে৷ বাড়িতে ফোন করে জানান হয়নি এখনো৷ একটা ফোন করার ব্যাবস্থা করে দাওনা.."
—"এই নাও, আমার ফোন থেকেই কল করে জানিয়ে দাও এখন৷ আমি একটু বাইরে থেকে আসছি৷"
মোবাইলটা তৃষাকে দিয়ে বেরিয়ে গেল সাগর৷ আধঘন্টা পর একটা মোবাইল আর জিও সিমকার্ড হাতে নিয়ে ঢুকল বাড়িতে৷
—"এই নাও তৃষা, এটা তোমার জন্য৷"
—"এ মা, তুমি মোবাইল কিনতে গেলে কেন? আমি বাড়িতে ফোন করে দিয়েছি৷"
—"এটা তোমার জন্য আমার গিফ্ট৷ What's app টা Install করে দিয়েছি৷ তোমার সাথে কথা তো বলতে পারব, যেখানেই থাকি৷"
কথাগুলো বেশ আবেগের সাথেই বলল সাগর৷ একলা ঘরে এক গভীর চুমু এঁকে দেয় তৃষা সাগরের ঠোঁটে৷
পরদিন সকালে তৃষার ফিরে যাবার কথা৷ একটুও ভাল লাগছেনা সাগরের, কদিন যদি থেকে যেত..... যাবার আগে কলকাতা গেলে দেখা করার প্রতিশ্রুতি, বাসে ওঠার আগে বারে বারে হাতে হাত ছুঁয়ে যাওয়া, দু চোখের চাউনিতে বিচ্ছেদের যন্ত্রনা সাগরের হৃদয়ে আলোড়ন তোলে৷
বাড়িতে পৌছে একবার ফোন করে জানায় যে পৌছে গেছে৷ এর পর আর কথা হয়নি এখনো৷ রাত্রে ফোন করে সাগর, ফোন বেজে চলে৷ Whats app এ ম্যাসেজ করে, নীল দাগ জানিয়ে দেয় তৃষা দেখেছে, কিন্তু কোন রিপ্লাই আসেনা৷ বেশ কিছুক্ষণ পর একটা ম্যাসেজ আসে..
"একটু ব্যাস্ত আছি, আজ সন্ধেবেলা কিছু বন্ধুদের সাথে বেরিয়েছি, পরে কথা বলছি৷"
সাগর রাত কাটায় সেই বিশেষ রাতের স্মৃতি রোমন্থন করে৷ রাত শেষ হয়ে সকাল হয়, প্রতিক্ষার সময় বেড়েই চলে৷ সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে সন্ধে নামে৷ সাগর ভাবে অনেকদিন পর তৃষা বাড়ি গেছে তাই সবার মাঝে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেনা৷ আবার ম্যাসেজ করে, নীল দাগ আসে, তবু রিপ্লাই নেই৷ এবার আবার ফোন করে সাগর... "আপনি যে নম্বরে ফোন করেছেন, সেটি ব্যাস্ত....." কল কেটে দেয় সাগর কিছুটা অভিমানের বশেই৷
দু দিন ভাল করে কথা হয়নি৷ মনে হাজার প্রশ্ন ভীড় করে আসে৷ কী মনে করে সাগর একবার ফেসবুকে তৃষার প্রোফাইল খোঁজার চেষ্টা করল৷ অনেক খুঁজে একটি প্রোফাইলে দেখে তৃষার ছবি, কিন্তু এ কোন তৃষা? হাতে হুক্কার পাইপ, সামনের টেবিলে নামান গ্লাসের তরলের রঙ দেখে মনে হচ্ছে ওয়াইন৷ পাশে একজন তৃষাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে আছে৷ দেখে গতকাল তৃষার স্টেটাস আপডেট....
"After a Long time at favorite Hukka Bar with my Sweetheart..."
(অনেকদিন পর প্রিয় হুক্কাবারে আমার প্রেমিকের সাথে৷)

ঝড় উঠল সাগরের মনে, ঝড়ের দিনের ছবিগুলো বারবার রিপ্লে হতে লাগল মনে৷ সমুদ্রের ধারের সব কথা, সেই চোখের চাউনি, জনশূন্য দ্বীপে একসাথে কাটানো সেই রাত, তার উষ্ন আলিঙ্গন, তৃষার শরীরে তার ঠোঁটের অবাধ বিচরন, চাঁদের জোছনায় দুই শরীরের মিলন, সবই কি মিথ্যে ছিল? নাকি ছিল শুধু মুহুর্তের আবেগ? তৃষার মনে কি এতটুকু জায়গা পায়নি সাগর? তাহলে কেন সেদিন একলা বাড়িতে তৃষার ঠোঁট পুনরায় মিলেছিল সাগরের সাথে? ভাবতে ভাবতে দ্রুত বেরিয়ে যায় সাগরা সমুদ্রের পাড়ে৷ সমুদ্রে জোয়ারের শব্দ, সাগরের সমস্ত জিজ্ঞাসা, রাগ, ক্ষোভ সশব্দে ফেটে পড়ে, হৃদয়ের হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে.......

                              ✍ প্রভাত ঘোষ৷

৪টি মন্তব্য:

꧁ জীবনপিপাসু ꧂