মরনের পরে


অফিসে প্রোজেক্টারে প্রেজেনটেশন শুরু করবে এবার৷  কোম্পানির নতুন ম্যানেজার পদ পেয়েছে রাহুল৷  প্রেজেন্টেশনের মাঝে হঠাৎ যেন ঝিলিকের মুখটা দেখতে পেল৷  কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও সামলে নিল নিজেকে৷  অফিস শেষ করে নিজের গাড়ি চালিয়ে ফ্ল্যাটে ফেরার সময় মনটা কেমন উতলা হয়ে উঠল৷  হঠাৎ কেন ঝিলিকের মুখ দেখতে পেল প্রজেক্টারের আলোতে?

 ফ্ল্যাটের নিচে গাড়ি রেখে লিফটে উঠে সোজা তিন তলায়৷  দরজা খুলে লাইট জ্বালাতেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল রাহুল৷  এত সাজান গোছান তো কোনদিনই ছিলনা৷  তাহলে কী ভুল করে... নাহ, আবার বাইরের দরজায় ঝোলান নিজের নামটা দেখে নিল৷  গরমও লাগছে অল্প, ফ্যানটা চালু করতেই একটা অদ্ভুত চেনা গন্ধে ভরে গেল ঘরটা৷  কিছুই বুঝতে পারছে না রাহুল৷  এ তো সেই ঝিলিকের চুলের খুব চেনা মিষ্টি গন্ধটা৷  তবে কি ঝিলিক.... নাহ, তা কিভাবে সম্ভব?  সে তো গ্রামেই আছে৷  কদিন আগেই বাড়িতে ফোন করে খবর নিয়েছে রাহুল৷  মায়ের সাথে কথা বলার পর মা ই ঝিলিককে ডেকে কথা বলতে বলল৷  গ্রামে এখনো মোবাইল পৌছোয়নি, ল্যান্ডলাইনেই যা কথা হয়৷  এই সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হাতে তুলে নিল মোবাইলটা৷  ফোন লাগছে না, এই ঝামেলা লেগেই থাকে গ্রামে৷  ঝড়ে কখনো তার ছিঁড়ে যায়, কখনো বা চুরি৷

 স্নান করে একটু শুয়ে পড়ল৷  রাত তখন ঠিক ন টা, ঘুমের মধ্যে কানের কাছে ঝিলিকের গলা... —"কি গো, খেতে যাবেনা৷ ন টা বাজে তো৷ যাও খেয়ে এস৷" হতভম্ব হয়ে উঠে পড়ল রাহুল৷  ঘড়িতে দেখে ঠিক রাত ন টা৷  আর পারছে না সে৷  এ কী হচ্ছে তার সাথে?  এটা কি বেশি ভালবাসার ফল?  আগেও এতটাই ভালবাসত, কই আগে তো এমন কিছু হয়নি৷
 ঠিক করল কাল সকালেই বাড়ি যাবে৷  এবার ঝিলিকের সাথে এনগেজমেন্ট করেই দিল্লি ফিরবে৷  অফিসে এমারজেন্সি বলে ফোন করে ছুটি নিয়ে নিল৷  ভোরেই ফ্লাইট ধরে কোলকাতা, তারপর শিয়ালদা থেকে লোকাল ট্রেন ধরে সুভাষগ্রাম৷

 এই গ্রাম তার ছোট থেকে বড় হবার সব ঘটনার সাক্ষী৷  ঝিলিক ছাড়া সবচেয়ে কাছের বন্ধু বলতে আশীষ৷  কত বদমাইশি করেছে দুজনে একসাথে৷  এই আশীষকেই রাহুল প্রথম তার ঝিলিকের প্রতি ভালবাসার কথাটা জানায়৷  একসাথে ক্রিকেট -ফুটবল খেলা, লোকের বাগানে আম চুরি, সরকার দীঘিতে সাঁতার কেটে পদ্মফুল আনা, এ সবকিছুই তারা করেছে একসাথে৷  আম পাড়তে গেলে তো ঝিলিককে সঙ্গে নিয়ে যেতেই হবে, নাহলে ঘরে ফিরে মারটা ফ্রি৷  ঝিলিক গাছের তলে দাঁড়িয়ে আম কুড়োত, আর দুজনে গাছে উঠে আম পাড়ত৷ 

 ঝিলিকের বাড়ি রাহুলের ঠিক দুটো বাড়ির পরেই৷  মা মরা মেয়েটা রাহুলের মা কে মা বলে ডাকত সেই ছোট থেকেই৷  এরপর একসাথে বড় হয়ে ওঠা৷  কলেজে উঠে প্রথম বুঝতে পারে রাহুল যে ঝিলিক ছাড়া জীবনের দিনগুলোকে সে কল্পনাও করতে পারবেনা৷  সে খাবার খেয়েছে কি না, জ্বর হলে বাড়িতেই এসে সারাদিন তার মাথার কাছে বসে গল্প করা, মায়ের সাথে রান্নাঘরে সবজি কাটা সবই করত৷  একদিন কয়েকজন বন্ধু মিলে কলেজ থেকে ঘুরতে গিয়েছিল ফলতা৷  ঝিলিকও ছিল সাথে৷  গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল, এমন সময় হঠাৎ পা পিছলে ঝিলিক পড়ে যায় জলে৷  কোনকিছু না ভেবে সঙ্গে সঙ্গেই ঝাঁপ দেয় রাহুল৷  রাহুলের কোলে জল থেকে উঠে আসার সময় ভয়ে গলা জড়িয়ে ধরেছিল ঝিলিক৷  এরপর একদিন হাওড়ার মিলেনিয়াম পার্কে গাছের তলায় প্রথম ছুঁয়েছিল দুটি ঠোঁট৷ 

 দুপুর তখন দুটো৷  গ্রামে ঢুকতেই বুকটা যেন একটা আতঙ্কে কেঁপে উঠল৷  পুরো গ্রামটা কেমন যেন থম মেরে আছে৷  একটা পাখিও ডাকছেনা আজ৷  বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেল ঝিলিকের বাড়ির কাছে ছেলে থেকে বুড়ো প্রায় সবাই জড়ো হয়েছে৷

 এগিয়ে গেল রাহুল৷  ভীড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল আশীষ৷  দু চোখে জল এখনো ছলছল করছে৷  উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল... —"কি হয়েছে আশীষ? ঝিলিকদের বাড়ির ওখানে এত ভীড় কেন?"  কান্নায় ফেটে পড়ল আশীষ৷  —"ও পাড়ার স্বপন কাল সন্ধে বেলা ঝিলিককে পুকুর ধারে একলা পেয়ে রেপ করে ওড়না দিয়ে গাছের সাথে ঝুলিয়ে দেয়৷"

 পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ায় দুজনের সামনে৷  তিনজন পুলিশ গাড়ি থেকে নেমেই হাতকড়া পরায় আশীষকে৷

 হতবাক রাহুল দেখে পোষ্টমর্টাম করা দুটি দেহ নামান হয় গাড়ি থেকে৷  সাদা চাদর ঢাকা দেহ দুটির মুখের ওপর থেকে চাদর সরাতেই দেখতে পায় তার ভালবাসা ঝিলিক আর পাশেই গলা কাটা স্বপনের দেহ৷  পুলিশের গাড়িতে উঠতে উঠতে আশীষ বলে... —"ছাড়িনি রাহুল, ছাড়িনি৷ শালাকে আজ ভোরে আমিই মেরে দিলাম"

এখনো অনুভব করছে কাল রাত্রে তার ফ্ল্যাটে ঝিলিকের উপস্থিতি, সেই চেনা গন্ধ, সেই গলার স্বর৷ কাঁধের ব্যাগটা মাটিতে ফেলে কান্নায় ফেটে পড়ে রাহুল৷ হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে৷ হঠাৎ এক দমকা হাওয়া রাহুলের কানে বলে যায় "ভাল থেকো"৷

"মেঘ চিঠিতে ডাক পাঠাল বৃষ্টি যেথায় ঝরে,
ঠোঁট দুখানি মিলবে আবার ঠিক মরণের পারে৷"
                           ✍ প্রভাত ঘোষ...🌠

সংগ্রামী

ইতিহাস আজ পরিবর্তিত না হলে সংগ্রামীদের তালিকার খাতার প্রথমদিকে কিছু নাম উঠে আসত ঠিকই৷ আজ জেনে নেওয়া যাক এরকমই এক মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীর আত্মত্যাগের কথা৷
#বটুকেশ্বর_দত্ত :
             পূর্ব বর্ধমান জেলার "ওয়ারি" গ্রামে জন্ম ১৯১০ সালের ১৮ই নভেম্বর৷ কলেজে পড়ার সাথে সাথেই বৃটিশদের শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করার প্রতিজ্ঞা দৃঢ় হয়ে বাসা বাঁধে ওই ছোট্ট হৃদয়ে৷ ভারতের স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে যোগ দেন উত্তরপ্রদেশের কানপুরের Hindustan Socialist Republican Associatio এ৷ প্রথম বোমা তৈরির হাতেখড়ি শুরু হয় সেখানেই৷ ধীরে ধীরে চন্দ্রশেখর আজাদ এবং ভগৎ সিং এর সাথে পরিচয়৷
এই প্রসঙ্গে আরও একজনের নাম উল্লেখ করতেই হয়, স্বামী কুমারানন্দ৷ ইনি বহুবার বটুকেশ্বর দত্তকে আশ্রয় দিয়ে বৃটিশ পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করেন৷
১৯২৯ সালে ভগৎ সিং এর সাথে দিল্লির Central Legislative Assembly তে বোমা ফেলার মত দুঃসাহসিক কাজ করেন বটুকেশ্বর তাঁর ১৯ বছর বয়সেই৷ ধরা পড়েন তিনি এবং ভগৎ সিং৷ আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দী করা হয়, যাকে বলা হত "কালা পানির সাজা"৷ একবিন্দু আলোও প্রবেশের জন্য বৃটিশ পুলিশের নির্দেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকত সেখানে৷ সকল বন্দীদের সঙ্গে নিয়ে জেলের মধ্যেই শুরু হয় অনশন, বন্দীদের ওপর পুলিশের অমানবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে৷ শেষে জেল থেকে দেওয়া হয় মুক্তি৷ এর পর তিনি অংশগ্রহন করেন ভারত ছাড়ো আন্দোলনেও৷
১৯৬৫ সালে টিউবারকিউলোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে AIIMS হাসপাতালে মৃত্যু হয়৷
এরকম একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম ভারত রত্ন প্রাপকদের মধ্যে না থাকলেও তিনি সর্বদাই ভারতের মানুষের হৃদয়ে থাকবেন সেটা বলাই বাহুল্য৷
এবার আসি আমার কথায়৷ অনেকেই নেহেরু, জিন্না এবং এডউইনা মাউন্টব্যাটেনের ( লর্ড মাউন্টব্যাটেনের স্ত্রী) মদিরা পান এবং উচ্ছৃঙ্খল জীবনের কথা নিশ্চই শুনে থাকবেন, যারা নিজেদের স্বার্থে করেছেন রাজনীতি৷ যে মানুষটি দেশের জন্য অনশন, পুলিশের লাঠি, অন্ধকার কারাগারে অকথ্য অত্যাচার সহ্য করে স্বাধীনতার বীজ থেকে গাছ হয়ে ফলে ফুলে বাড়িয়ে তুললেন তাঁদের আজও ভারতরত্নের তালিকায় স্থান দেওয়া হয়নি, কিন্তু পেয়েছেন চাচা নেহেরু৷ এ বিষয়ে বিবেচনার দায়ীত্ব তুলে দিলাম একশ ত্রিশ কোটি ভারতবাসীর ওপর৷
                              জয় হিন্দ
                       ✍ প্রভাত ঘোষ...

꧁ জীবনপিপাসু ꧂