ভালবাসার রাজনীতি

                       *** প্রথম পর্ব ****
বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠান, সকাল থেকেই বক্সে সব নতুন বাংলা গানের সুর৷ কখনো বা একটু পুরান মিতা চ্যাটার্জির গান "পালকিতে বৌ চলে যায়"৷ আবার একবার করে সেই খুব চেনা রবীন্দ্রসঙ্গীত "আমার পরান যাহা চায়"৷

নন্দিনী, সিউড়ির লাভপুর গ্রামের এক খুবই সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে৷ সদ্য গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল ইয়ার দিয়েছে শম্ভুনাথ কলেজ থেকে৷ গায়ের রঙ একটু শ্যামলা হলেও মুখশ্রী বেশ সুন্দর৷ নন্দিনী বেশ প্রানচঞ্চল পরীর মতো৷ মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে বলে বাড়ি থেকে ভাল একটা সম্বন্ধ দেখেছে৷ ছেলের বেশ ভাল ব্যাবসা আছে আসানসোলে৷ কয়লার ব্যাবসা৷ যাই হোক, ছেলের বাড়ি বেশ বড়লোকই বলা যায়৷ তাই আর দেরি না করে সম্বন্ধ পুরো পাকা৷

রাহুল, বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান, নন্দিনীর খুব ভাল বন্ধু৷ একই কলেজ থেকে পাশ করেছে দুজনে, শুধু সাবজেক্টটাই যা আলাদা ছিল৷ নন্দিনীর বাংলা আর রাহুলের ইকনমিক্স৷ পরিচয়টা বেশ সহজাত ভাবেই হয় নবীন বরনের দিন৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাটা দারুন বলেছিল নন্দিনী সেদিন কলেজের মঞ্চে দাঁড়িয়ে৷ রাহুলও কবিতা বেশ পছন্দ করে৷ হয়ে গেল আলাপ সেই রবি ঠাকুরের ছন্দ ধরেই৷
রাহুল বেশ ভাল গীটার বাজায়৷ সেই সূত্রে ভালই নাম ডাক কলেজে৷ পড়াশুনাতেও বেশ ভাল, তার সঙ্গে সেই গিটারিস্টদের মত স্টাইলিশ লুক৷ কত মেয়ে যে পেছনে পড়েছিল তার ইয়ত্তা নেই, কিন্তু রাহুলের পছন্দ সেই চুড়িদার পরা চুল খোলা নন্দিনীকে৷ বলতে পারেনি যদিও কখনো৷ একদিন বলতে চেয়েছিল বৈকি মনের কথাটা অকপটে, কিন্তু পারেনি৷ ঐ একটাই ভয়, বন্ধুত্ব হারাবার৷ কষ্টে বুকের পাঁজরের হাড়গুলো হৃদয়ে ড্রাম বাজালেও পারেনি সে বলতে, আর হয়তো কোনদিন পারবেও না৷ তার গোপন ভালবাসা হয়তো বৃষ্টিহীন খরা জৈষ্ঠে অসহায় তৃষ্ণার্ত ধান গাছের মতো আস্তে আস্তে ঢলে পড়বে মৃত্যুর বুকে৷ তবু তার বন্ধুত্ব সর্বদাই খামারে পড়ে থাকা খড়ের মতো সেই জৈষ্ঠের স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে আজীবন৷ 
তার এই মনের কথার স্বাক্ষী ছিল মাত্র একজনই, নন্দীনির কাকার মেয়ে স্বপ্না৷ সেও একই কলেজেই পড়ত৷ যেদিন প্রথম জানতে পারে কথাটা সেদিন নন্দিনী কলেজে আসেনি৷ ছিল বৃষ্টির দিন, তাই কমন রুমে রাখা গীটারটা নিয়ে আপন মনেই গান গাইছিল রাহুল.....
"ক্যা জানু সজন হোতি হ্যা ক্যা গম কে শাম, জ্বল উঠে শ দিয়ে জব লিয়া তেরা নাম"....

স্বপ্না আবার একটু বেশি স্টাইলিশ, জিন্সের সাথে হলুদ টপ পরে কমন রুমে ঢোকার আগেই শুনতে পায় গিটারের শব্দ৷ একটা চেয়ার টেনে মন দিয়ে শুনছিল রাহুলের গান৷ গান শেষ হতেই...👏👏👏👏👏👏 হাততালি...
—"উফফ রাহুল, যা গাইলি না গানটা..."
—"থ্যাঙ্ক ইউ..☺"
—"তা এত কষ্ট কার জন্য শুনি?"
—"আরে না, তেমনি কিছু নয়৷"
—"আচ্ছা, এবার নভেম্বরে যে প্রোগ্রাম আছে কলেজে ওখানে গাইবি তো?"
—"হ্যা, ভাবছি তাই৷"
—"তোর গান আমার দারুন লাগে৷ আর..."
—"আর কি? বল..."
—"নাঃ, কিছু না৷"
—"আচ্ছা স্বপ্না শোন না, নন্দিনী আজ আসেনি কেন রে? তোরা তো একই সাথে আসিস৷"
—"ওহঃ, ওর জ্বর হয়েছে, কদিন আসবেনা"

কথাটা শুনে রাহুলের কতটা খারাপ লাগল সেটা মুখ দেখলেই যে কেউ বুঝতে পারবে৷
—"কেন রে? আজ নন্দিনীর জ্বরের কথা শুনে এত খারাপ লাগছে যে তোর?"
—"তেমন কিছু না৷ শরীর খারাপ বললি তো তাই৷"
—"আচ্ছা, আমিও তো আগের মাসে জ্বরে পড়ে কলেজ আসিনি তিন দিন, আমার কথা জিজ্ঞেস করেছিলি?"

এ কথার মানানসই উত্তর খুঁজে পায়না রাহুল৷

—"কি রে, বললি না যে৷"
—"হ্যা, নন্দিনী বলেছিল৷"
—"ওহ, মানে তুই জানতে চাসনি৷"

এবার আর কিছু বলতে পারল না রাহুল৷ ভগবান সহায় হয়ে যাক বৃষ্টিটা ততক্ষণে থেমে গেছে৷ রাহুল বলল...
—"স্বপ্না, চল বৃষ্টি থেমে গেছে৷ এবার যাওয়া যাক৷"

স্বপ্না এই মুহুর্তটা হারাতে চাইছিল না, তবুও যেতেই হল৷ রাহুলকে মনে মনে বেশ পছন্দ করলেও নন্দিনীর প্রতি বেশি মনযোগ দেওয়া একেবারেই সহ্য করতে পারত না৷ একদিন ওর মোবাইলে কলেজের গ্রুপ ফটো থেকে ক্রপ করে শুধু নন্দিনী আর রাহুলের একসাথে তোলা ছবিটা Wall Paper করে রাখা দেখে স্বপ্নার বুঝতে অসুবিধে হল না৷

নন্দিনীর প্রতি একটা ঈর্ষা মনের মধ্যে ধীরে ধীরে পুষছিল স্বপ্না৷ একদিন তিনজনেই আছে কমন রূমে ক্লাস শেষের পর, এমন সময় স্বপ্না রাহুলের হাতটা ধরে বলল...
—"রাহুল, আজ একটা গান শোনা না৷ অনেকদিন শুনিনি তোর গান৷"
যদিও এটা শুধুই নন্দিনীকে দেখাবার জন্যেই ছিল৷ আবার মাঝে মাঝে বাড়িতেও কথার মাঝে খোঁটা দিত...
—"তোর বিয়েতে কলেজের সবাই মিলে একজায়গায় আসর জমিয়ে বেশ আড্ডা দেব৷ রাহুলকে বলব গীটারটা নিয়ে আসতে৷ সবাই মিলে বরযাত্রি যাব, খুব মজা হবে৷"

এসব কথায় যদিও নন্দিনী কিছুই মনে করত না৷ তবে বেশ বুঝতে পারত রাহুলের প্রতি ওর ক্রাশ৷

                         *** দ্বিতীয় র্ব***

বিয়ের ঠিক আগের দিন ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্টের কথাটা Whats app গ্রুপেই জানতে পারল নন্দিনী৷ স্বপ্নাকেও জানাল...
—"বুনি, আজ কলেজে রেজাল্ট তুই জানিস?"
—"হ্যা জানি, কিন্তু আজ আর যাবনা৷ তোর বিয়ের পরই আবার কলেজ যাব৷ কালই তো ফেসিয়াল করলাম, এখন কদিন বাইরে বেরোবনা৷ তুই গেলে যা, বিয়ের পর কী আর যেতে পারবি৷"

এ ধরনের কথা এখন গা সওয়া হয়ে গেছে, কিছু মনে হয়না৷ নন্দিনী বেরোল কলেজের উদ্দেশ্যে৷ বেশ মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি তখনো হয়নি৷ রাহুলের সাথে ফোনে কথা বলে জানল সেও আসছে৷ এরপর কলেজে পৌছে লিস্ট দেখে মনটা শান্ত হয়৷ ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে৷ সবার সাথে ক্যান্টিনে দেখা, রাহুলও আছে৷ বিয়ের কথা জানে তো সবাই তাই আজকের আড্ডার মুখ্যমণি নন্দিনী৷ রাহুল কেমন যেন একটু বেশিই চুপচাপ আজ, তার পাশেই বেঞ্চে বসা রাহুলকে একটু ঠেলা দিয়ে...
—"কি রে, কিছু ভাবছিস নাকি?"
—"না, কই কিছু না তো৷"
—"আচ্ছা, কাল সকাল সকাল চলে আসিস বাড়িতে৷"
—"বিয়ের জন্য খুব তাড়া ছিল না রে তোর?"

হঠাৎ এরকম কথায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে৷ যদিও নন্দিনী কিছুটা হলেও বুঝতে পারত রাহুলের মনের না বলা কথা৷ তবুও পরিবারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে মেনে নিয়ে মত দেয় বিয়েতে৷ কথা ঘোরাবার জন্য বলল..
—"দেখ এবার মেঘ কিন্তু বেশ কালো হয়ে আসছে৷ বৃষ্টি নামার আগে বাস ধরতে হবে৷ চল্ , উঠতে হবে এবার৷"
বলেই মার্কশিট ভরা ফাইলটা ব্যাগে ভরে উঠে গেল নন্দিনী৷ রাহুলও আর কথা না বাড়িয়ে চলল সঙ্গে৷ বাসে উঠেই শুরু হল বৃষ্টি৷ প্রায় একঘন্টা পর বাস স্ট্যান্ডে নেমে দাঁড়াতেই হল একটা দোকানে৷ রাহুলও সঙ্গেই আছে৷ মাঝে মাঝে কিছু কথা,আবার নিস্তব্ধতা৷ 
সন্ধে তখন ৬:৩০, বৃষ্টি থেমেছে কিন্তু মেঘ তখনো ঘোর করে আছে৷ রাহুল বলল...
—"চল্ , তোকে বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসি৷"
—"না না, তার দরকার নেই৷ এই তো একটুখানি, একাই হেঁটে চলে যাব৷ তুই বাড়ি যা, কাল সকাল সকাল চলে আসিস৷ তোরা সবাই থাকলে ভাল লাগবে৷"
—"সামনে জঙ্গল পেরিয়ে প্রায় কুড়ি মিনিট হাঁটতে হবে তোকে একা৷ এই সময় কোন রিক্সাও তো দেখছি না৷ আমি বরং যাই তোর সাথে৷"
—"আরে বলছি তো আমি ঠিক চলে যাব, তুই যা বাড়ি৷ তোর নাহলে বাড়ি ঢুকতে অনেক দেরি হয়ে যাবে৷"

হাঁটা দিল নন্দিনী৷ একটু ঝোড়ো হাওয়া ছলছে৷ রাস্তার পাশের আলোগুলো জ্বলে গেছে, কিন্তু এক গাঢ় নিস্তব্ধতা যেন গ্রাস করেছে অঞ্চলকে৷ বেশ কিছুদূর যেতেই দুটো বাইকের হর্ণ দেবার শব্দ এল পেছন থেকে৷ দু বার, চার বার, এবার একদম সামনে এসে দ্রুত হাঁটতে থাকা নন্দিনীকে লোলুপ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে এগিয়ে গেল বাইকগুলো৷ খানিকটা এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ দেখে মনে হচ্ছে মদ্যপ, নিজেদের মধ্যেই গালাগালি করছে৷ একটু সামনে আসতেই শুনতে পেল...

—"ভাই, কি লাগছে মালটা৷ সাইজ দেখেছিস?"
কথাটা শুনতে পেল নন্দিনী৷ ঘৃনার দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আবার পাশ কাটিয়ে যেতে লাগল, এবার ঘটল বিপত্তি৷
১ম ব্যাক্তি —"আরে মালটা এভাবে দেখল কেন  বলতো? চল শালিকে দেখছি আজ৷"
২য় ব্যাক্তি — " ওরে মাগি, খুব তেজ দেখছি৷"
বলেই পেছন থেকে ওড়না টেনে নিল৷ বেশ সপাটে চড়টা কষাল পেছন ঘুরে নন্দিনী৷ 
৩য় ব্যাক্তি — " এই শালি, গায়ে হাত তুললি! ওঠা শালা একে৷"

দুহাত ধরে নিল একজন৷ পেছন থেকে মুখটা ওড়না দিয়ে বেঁধে দুজন পা দুটো ধরে উঠিয়ে নিয়ে যেতে যেতে খিস্তি আওড়াতে লাগল৷ নন্দিনী তখন আধকাটা জ্যান্ত মাছের মত ছটফট করতে লাগল৷ পা দিয়ে লাথি মারার চেষ্টা বিফল৷ রাস্তা থেকেই একটু দূরে একটা ঝিল, তার ধারেই বুনো খেজুর আর কিছু বুনো গাছের ঝোপ৷ পাশেই মাটিতে ফেলে দিল নন্দিনীকে৷ এরপর প্রায় আধঘন্টা ধরে সেই আধকাটা ছটফট করা মাছের শরীরে একের পর এক বড়শির আঘাত৷ প্রতিটি আঘাতের চিৎকার বাঁধা পড়ে থাকে ওড়নার শক্ত বাঁধনে৷ প্রতিবার হৃদয় করে হাহাকার, নষ্ট শরীরে ওঠে বেদনার ঝড়৷ না, শুধুই শারীরিক নয়, সামাজিকতার সংবিধানের পাতায় কালো দাগের কথা মনে হতেই এক অসহ্য বিবেক দংশনে নিথরের ন্যায় অসাড় শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে রয় ঘাসের বিছানায়৷ এখনো মদ্যপ দানবেরা অত্যাচার ছাড়েনি৷ হঠাৎ একজনের মনে হল .....
—"এ ভাই, মরে গেছে মনে হচ্ছে৷ ওঠ, পালা....."
এবার পালাল তিনজনেই৷

                         *** তৃতীয় পর্ব ***
— "না, মরেনি এখনো, নিঃশ্বাস চলছে৷ মুখে জলের ছিটা দে৷ জল আন রে কেউ৷ নন্দিনী, এই নন্দিনী, ওঠ দেখ আমি রাহুল৷ ওরে, তোরা এম্বুলেন্সকে ফোন করেছিস?"

রাত্রে নন্দিনীর ফোনে  বারবার কল করে রাহুল৷ ফোন বন্ধ দেখে শেষে স্বপ্নাকে ফোন করে জানতে পারে বাড়ি ফেরেনি৷ ততক্ষণে নন্দিনীর বাড়িতে দুশ্চিন্তার ছায়া৷ পুলিশের সাথে সারারাত তন্নতন্ন করে খুঁজে শেষে ভোরের আলো ওঠার কিছুক্ষণ পর দেখতে পাওয়া যায় তার সজ্ঞাহীন দেহ৷ দেখামাত্রই নিজের জামা খুলে বেঁধেদেয় নন্দিনীর কোমরের সাথে৷ 
হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষ৷ জ্ঞান ফিরে এসেছে ঘন্টাখানেক পর৷আজই তো বিয়ের দিন৷ রাত্রে বরযাত্রি আসবে৷ ছেলের বাড়িতে তখনো কোন খবর যায়নি৷ হঠাৎ ঘটা এহেন ঘটনা পাত্রির বাবার মুখের ভাষা কেড়ে নিয়েছে৷ যেন এক জড় পদার্থ সর্বক্ষণ ওই মা হারা মেয়েটির চিকিৎসার জন্য সারাদিন পড়ে আছে হাসপাতালে৷ 
বাড়িতে বড় ছেলে নেই কেউ তাই রাহুল সবসময় সঙ্গেই রয়েছে৷ থাকবে নাই বা কেন? তার মনের গভীরে প্রথম ভালবাসার বীজ বোনা সেই রমণী আজ শরীরে এবং হৃদয়ে বিষ দংশনে ফালাফালা হয়ে গেছে৷ এ বিষ সমাজের মধ্যে মানুষের মুখোশধারী জানোয়ারদের বিষ৷ কখনো রাহুল বেডের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে৷ নন্দিনীর বাবা মেয়েকে একটু সুস্থ দেখে আবার পুলিশ স্টেশনে দৌড়েছে বিচারের আশায়৷ ঘন্টাখানেক পর পুলিশকে সাথে নিয়েই ঢুকলেন৷ এবার শুরু হবে পুলিশি জেরা৷
—"তোমার নাম?"
চোখের জল তখনো গড়িয়ে পড়ছে নন্দিনীর৷ কখনো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে৷ বাবা গিয়ে বসে মেয়ের পাশে৷ লজ্জায় দু হাতে মুখ ঢেকে নেয় নন্দিনী৷ পাশে বসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন..
—"কাঁদিসনা মা৷ আমি এখনো বেঁচে আছি, ওই শয়তানদের শাস্তি হবেই৷ তুই কোন চিন্তা করিসনা, তোর বাবা সবসময় তোর পাশে আছে৷ তুই সব খুলে বল পুলিশকে৷"

বাবার সামনে কিছু বলতে ইতস্ততঃ বোধ করছে৷ বুঝতে পেরে রাহুলকে সঙ্গে থাকতে বলে নিজে বেরিয়ে গেলেন ডাক্তারের সাথে কথা বলার অযুহাতে৷ একজন মহিলা পুলিশ আবার জিজ্ঞাসা করে...
—"কতজন ছিল ওরা?"
মুখ নিচু করেই উত্তর দেয়..
—"তিনজন৷"
—"কি নাম ছিল বলতে পারবে? এর আগে দেখেছ কখনো এই অঞ্চলে?"
—"না৷"
—"কখন হয়েছে?"
—"কাল সন্ধেবেলা, কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার সময়৷"
—"ওদের দেখলে চিনতে পারবে?"
ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতিসূচক জবাব দিল নন্দিনী৷
—"ওরা কি গাড়ি নিয়ে ছিল?"
—"হ্যা, দুটো বাইক৷"
—"আচ্ছা তুমি সুস্থ হয়ে যাও৷ চিন্তা করবেনা, আমরা ওদের খুঁজে বের করবই৷"
এবার রাহুলকে বলে..
—"পুলিশ ওই জায়গার তল্লাশি চালাচ্ছে৷ কিছূ জানতে পারলেই আপনাদের জানান হবে৷ কাল সকালে এর বাবাকে থানায় আসতে বলবেন৷"
এই বলে পুলিশ বেরিয়ে গেল হাসপাতাল থেকে৷

সকাল প্রায় ১১:৩০ বাজে তখন বাড়ি থেকে নন্দিনীর কাকা আর সঙ্গে স্বপ্না দেখা করতে আসে, একঘন্টা থাকার পর বাড়ি ফিরে যায়৷

তখন বিকেল প্রায় ৪টে বাজে, হঠাৎ নন্দিনীর বাবার খেয়াল হল পাত্রপক্ষ তো নিজের সময়েই আসবে৷ তখন কি হবে? বাড়ির সম্মান নিয়ে সমাজের মানুষ কিৎকিৎ খেলতে ছাড়বে না৷ হাজার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে৷ মেয়েটাকে কেউ ছেড়ে কথা বলবে না৷ নাঃ, নন্দিনীকে এখন বাড়ি নিয়ে যাওয়া চলবে না৷ এবার ফোন করে নিজের ভাইকে পরামর্শের জন্য৷
—"পাত্রপক্ষ তো কিছুই জানেনা৷ তুই ওদের এক্ষুনি ফোন করে বলে দে বিয়ে হবেনা৷"
—"কি বলছ দাদা! কত রকমের প্রশ্ন উঠবে তাহলে৷ ওরা তো এতক্ষনে বেরিয়েও গেছে মনেহয়৷ এভাবে বললে বাড়ির মান সম্মান সব নষ্ট হয়ে যাবে৷ আমারো একটা মেয়ে আছে দাদা, তার বিয়ের জন্য পাত্র পাওয়া যাবে পরে এরকম কিছু ঘটলে?"
—"তাহলে কি করা যায় তুই বল?"
—"আচ্ছা আমি বাড়িতে আলোচনা করে জানাচ্ছি৷"
প্রায় আধঘন্টা পর ফোনটা বেজে ওঠে নন্দিনীর বাবার৷

                       *** চতুর্থ পর্ব ***

শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয়ে গেল, শুধু কন্যের চরিত্রে স্বপ্না বসেছিল পিঁড়িতে৷ নন্দিনী বিয়ের পরের দিন যাবে ভাবল নিজের বাড়িতে, বাবা এসে যা শোনাল তার সারসংক্ষেপ হল — "ধর্ষনের জন্য ধর্ষিতাই দায়ী"৷ পাড়ার এক কাকিমা তো বলেই ফেলল..
—"তোমরা বাপু যাই বলনা কেন আমার তো প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল মেয়েটা নষ্টা, কই অন্য কারোর সাথে তো হয়নি৷ কী দরকার ছিল বিয়ের আগের দিন বাড়ির বাইরে যাবার৷"
এই কথার বিরুদ্ধে আর কোন কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি তার বাবার৷ এ হেন অশিক্ষিত, অমানুষিক এবং অমানবিক মানুষের কথার উত্তর দিতেও বিবেকে বাঁধে৷ হাসপাতালে আর কদিন রাখা যায়? এবার তো এখান থেকে নন্দিনীকে নিয়ে যেতেই হবে৷ রাহুল সব পরিস্থিতি দেখে নন্দিনীর বাবার কাছে একটা প্রস্তাব দিল...
—"কাকু, যদি কিছু মনে না করেন আমি কি কিছু প্রস্তাব রাখতে পারি?৷
—"হ্যা, বল না বাবা, তোমার কথায় কিছু মনে করবে সে ধৃষ্টতা আমার মনের নেই৷ তুমি যা করেছ আমাদের জন্য তা তো আমার নিজের মানুষেরাও করেনি৷"
—"এভাবে বলবেন না৷ আমি আপনার ছেলের বয়সি৷ এ তো আমার কর্তব্য৷ মানুষ যদি মানুষের পাশে না দাঁড়ায়, তাকে মানুষ রূপে পরিচয় দিতে মনুষ্য জাতির লজ্জা হওয়া উচিৎ৷ আচ্ছা, কাকু নন্দিনী যদি আমাদের বাড়িতে কদিন গিয়ে থাকে.... বাড়িতে আমার বোন, মা সাবাই আছে৷ আমি মায়ের সাথে কথাও বলেছি৷ আর নন্দিনী যদি এখন আপনার সাথে বাড়ি যায় তবে পাড়ার লোকের কথার বিষদংশনে আরও ভেঙে পড়বে৷"
—"তা তো ঠিক, কিন্তু তা বলে তোমাদের বাড়িতে...."
—"ও নিয়ে একদম ভাববেন না৷ আমার বাড়িতে কোন অসুবিধে নেই৷ শুধু আপনি সংকোচ করবেন না৷ আমি নন্দিনীকে বুঝিয়ে বলছি৷"

বাথরুম যাবার জন্য উঠে কথাগুলো আড়াল থেকে শুনে ফেলল নন্দিনী৷ চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল৷ প্রথম ফোঁটায় লেখা ছিল এমন সুন্দর হৃদয়ের এক বন্ধু পাবার জন্য ভগবানকে ধন্যবাদ৷ দ্বিতীয় ফোঁটায় সমাজের সেই মানুষগুলোর প্রতি ঘৃনা, যারা মুখ বেঁকায় ধর্ষক নয় ধর্ষিতাকে দেখে৷ 
অনেক সংকোচ কাটিয়ে শেষে নন্দিনী, তার বাবা আর রাহুল রওনা দিল রাহুলের বাড়ির দিকে৷ ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে ট্যাক্সিতে করে প্রায় কুড়ি মিনিটের রাস্তা৷ পৌছানোর আগেই রাহুলের মা দাঁড়িয়ে ছিল আপ্যায়নের জন্য বাড়ির বাইরে৷

রাহুলের বাড়িতে কেটে গেল বেশ কটা দিন৷ একদম বাড়ির মেয়ের মতো রয়েছে এখানে৷ রাহুলের মা কে নিজের মায়ের মতোই মনে করে নন্দিনী৷ আসলে মায়ের ভালবাসা সে তেমন পায়নি  কী না, তাই৷ রাহুলের মায়ের তো নন্দিনীকে বেশ ভাললাগে৷ নন্দিনী এ বাড়িতে আসার পাঁচ দিনের মাথায় রাহুলের বাড়িতে একটা চিঠি এল৷ আন্দামানে চাকরির পরীক্ষাতে পাশ করেছে, তারই কল লেটার এসেছে৷ বাড়ির সবাই বেশ খুশি৷ ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার একমাস পরেই এই পরীক্ষাটা ছিল৷ সরকারী বলে কথা, তাই বাড়িতে সেদিন সন্ধে বেলাটা বেশ ভালই কাটল৷ স্পেশাল আয়োজন ছিল রাত্রের খাবারে, মটন, পোলাও৷

আজ স্বপ্নার অষ্টমঙ্গলা, বাপের বাড়ি আসবে৷ নন্দিনীকে ফোন করেছিল, শুধু দেখা করা বা তার খবর নেবার জন্য নয়, বাড়িতে দেখা করে নিজের বড়লোক স্বামী আর শ্বসুরবাড়ির গুণগানের জন্য৷ ওই যাতে একটু খোঁটা দিয়ে গায়ের জ্বালা মেটে তার জন্য৷ নন্দিনী তবুও যাবে দেখা করতে৷ বোন বলে কথা৷ নন্দিনী বেরোবার আগে রাহুলের মা বললেন...
—"আমি তোকে আজীবন আমার মেয়ে করে রাখতে পারলে খুশি হব৷"
এ কথার মানে বোঝার মত যথেষ্ট বয়স নন্দিনীর হয়েছে৷ যাই হোক এবার নিজের বাড়ি যাবার পালা৷

বাড়িতে পৌছে দেখে স্বপ্না ততক্ষণে এসে গেছে৷ কেউ কিন্তু কোন খারাপ ব্যাবহার বা কটাক্ষ করেনি এখনো৷ একই বিছানায় বসে দুই বোন মিলে বেশ গল্প চলছে৷ এমন সময় কাকিমা পাশের ঘর থেকে ডাক দিল স্বপ্নাকে৷ স্বপ্না বলে গেল..
—"তুই এখানেই থাক, আমি আসছি এক্ষুনি৷"
কথা বলার সময় কেন যে বার বার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে স্বপ্না, ঠিক বুঝতে পারছে না নন্দিনী৷ এ কী এক ধর্ষিতা বোনের প্রতি দয়া বা করুণার প্রভাব!!
পাশে পড়ে থাকা মোবাইলের আলোটা জ্বলে উঠল৷ স্বপ্নার মোবাইল, বিছানায় ফেলেই চলে গেছে৷ পর পর চার বার মেসেজ টোন বেজে উঠল৷ হঠাৎ মোবাইলটা হাতে নিতেই Whats app এর মেসেজের সাথে সেই খুব চেনা জঘন্য একটা চেহারা দেখতে পেল নন্দিনী, যে সেদিন রাত্রে প্রথম নন্দিনীর শরীরে বিষ ঢেলেছিল৷ 
গা টা রি-রি করতে লাগল৷ ঘৃনায়, অপমানে, রাগে, ক্ষোভে ফেটে পড়তে লাগল হৃদয়টা৷ মেসেজ খুলে পড়তে গিয়ে দেখে...
"ম্যাডাম, তোমার প্রেমের প্রতিশোধ তো নিলে, আমার বাকি পাঁচ হাজারটা আজই লাগবে৷ কথামতো ঠিক অষ্টমঙ্গলার দিনেই যোগাযোগ করলাম৷"
আর ঠিক থাকতে পারল না নন্দিনী৷ নিজের মোবাইল থেকে মেসেজের একটা ফটো তুলে রাহুলকে পাঠিয়েই সঙ্গে সঙ্গে ফোন...
—"হ্যালো, রাহুল, আমাকে নিয়ে যা এসে বাড়ি থেকে, এক্ষুনি"...

                           ✍ প্রভাত...

৩টি মন্তব্য:

  1. শেষের ক'টা লাইন শব্দ কেড়ে নিল। অবশেষে কিনা নিজের বোন এইরকম জঘন্য কাজ টা করল। ধিৎকার জানাই স্বপ্নার মত বোন দের আর সাথে সেই সমাজ কে, যারা কিনা ধর্ষক কে নয়, নন্দিনীর মত নম্র, ভদ্র মেয়েকে বারংবার ধর্ষন করছে নিজেদের নোংরামো কথার মাধ্যমে।

    উত্তরমুছুন
  2. Shocking.. I feel for Nandini.. and Rahul.. That's called a gentleman..thumbs up to u man..

    উত্তরমুছুন

꧁ জীবনপিপাসু ꧂